Sunday, 12 October 2014

ট্রেন লাইন

আমার এক বন্ধুর ঘটনা। বছর আগের ঘটনা। আমরা তখন
চট্টগ্রাম পুরনো রেল স্টেশনের
পাশে থাকতাম। আমি তখন
পুরো মাদকাসক্ত ছিলাম। প্রতিদিন
রাতে বন্ধুদের সাথে রেল
লাইনে আড্ডা দিয়ে মদ, গাজা,
হিরোইন খেতাম। আমাদের পছন্দের
আড্ডা দেয়ার জায়গাটা ছিলো দুই
রেললাইনের মাঝ বরাবর।
মানে আমাদের ডান পাশেই ট্রেন
চলাচল করতো।
জায়গাটা পুরো অন্ধকার ছিল। ঝোপ-
ঝাড় গাছপালায় ভরা। ষ্টেশন গার্ড
ছাড়া দিনের বেলায় কেউ সাহস
করতো না ওখানে যেতে। সবাই ঐ
জায়গাটাকে ভয় পেত।
বলতো ওখানে নাকি অনেক মানুষ
মারা গেছে ট্রেনে কাটা পড়ে।
আমরা ঐসব পাত্তা দিতাম না।
বরং আমাদের জন্য সুবিধাই হত। মাঝে-
মধ্যে দিনেও নেশা করতাম
ওখানে গিয়ে। একদিন রাতে আমরা ৪
জন মিলে নেশা করে ওখানে ঘাসের
উপরে শুয়ে ছিলাম। চাঁদের আলো ছিল
তাই ভাল লাগছিল। ৪ জনই
মোটামুটি মাতাল মাতাল অবস্থায়
ছিলাম। আমার হাল্কা চোখ
বুজে আসতেই হটাত একটি কান্নার শব্দ
শুনতে পেলাম। আমি উঠে দেখলাম
আমাদের থেকে প্রায় ৩০ হাত দূরে,
ছোট একটি বাচ্চা রেললাইনের
উপরে শুয়ে আছে আর কান্না করছে।
আমি এই দৃশ্য দেখে ভয় পেয়ে গেলাম।
আসে-পাশে কোন ঘর-বাড়িও নেই।
যে বাচ্চাটা ওখান থেকে আসবে!!
তারপর আমি বন্ধুদের ডাকতে লাগলাম।
কিন্তু আমার বন্ধুরা উঠল না।
ঘড়ি দেখলাম, তখন বাজে রাত
৩টা বেজে ৪০মিনিট। প্রায় ২০
মিনিট ধরে বাচ্চাটার কান্নার শব্দ
শুনতে পেলাম। শব্দ বন্ধ হওয়ার পর
বন্ধুদের জাগিয়ে সব খুলে বললাম।
তারা বিশ্বাস করল না। বলল
হয়তো বিড়াল-টিরাল হবে। আমিও
বিষয়টাকে পাত্তা দিলাম না।
তারপর প্রতিদিনকার মতো সবাই
ফজরের আজান এর ১ঘণ্টা আগে বাসায়
চলে গেলাম।
বিষয়টাকে পাত্তা না দেয়াটাই
ছিল আমার জীবনের মস্ত বড় ভুল। কারন
এরপর দিন আমার জীবনে যে ভয়াবহ
ঘটনাটা ঘটেছিল তা হয়ত আমার
প্রানটাই কেড়ে নিত। আর ছিন্ন ভিন্ন
করে দিত আমার এই দেহ। ঠিক এরপর
দিন আমরা ৪ জন
মিলে আবারো সেখানে আড্ডা দেই।
কার্ড খেলার পর আমরা প্রচুর
পরিমাণে ড্রিঙ্কস করি। তারপর
আমরা আগের মতো ওখানে শুয়ে পড়ি।
ঠিক রাত ৩টার
দিকে বন্ধুরা আমাকে জাগিয়ে তুলল।
বলল তাদের নাকি শরীর খারাপ
লাগছে। দুজন বমিও করেছে।
তারা আমাকে বাসায়
চলে যেতে বলল। তারাও চলে যাচ্ছে।
কিন্তু ড্রিঙ্কস বেশি করাতে আমারও
পুরো মাথা ব্যাথা এবং ঝিম
ধরেছিল। আমি ঘুমের ঘোড়ে তাদের
যেতে বললাম। কিন্তু
ফ্রেন্ডরা আমাকে বার বার
জাগিয়ে তুলতে লাগলো আর
আমি বিরক্ত হয়ে তাদের যেতে বললাম
আর শুয়ে পরলাম। তারাও বিরক্ত
হয়ে চলে গেল। তারা যাওয়ার
কিছুক্ষণ পর হটাত আমার ঘুম ভাঙল
একটি মেয়ের কান্নার শব্দ শুনে।
উঠে তাকিয়ে দেখলাম চাঁদের
আলোতে একটি মেয়ে রেল লাইনের
উপরে হাঁটু গেড়ে বসে, মাথা নিচু
করে খুব জোরে জোরে কান্না করছে।
গতকাল ছোট
বাচ্চাটা যেখানে ছিল ঠিক ওই
জায়গাতেই মেয়েটা বসে আছে।
মেয়েটা এত জোরে কান্না করছিল
যে, মনে হচ্ছিল কেউ তাকে মারছে।
আমি ঘুম থেকে উঠে এই
মেয়েকে দেখে ভয় পেয়ে যাই।
পরে ভাবলাম হয়ত রেল স্টেশনের
পাগল-টাগল হবে। সাহস করে ''এই,
কে রে?'' বলে কয়েকবার ডাক দিলাম।
কিন্তু কোন রিপ্লাই পেলাম না।
মেয়েটা কেঁদেই চলেছে।
আমি বিরক্ত হয়ে লাইন
থেকে একটি শিল পাথর নিয়ে তার
দিকে ছুঁড়ে দিলাম।
পাথরটা মেয়েটার পাঁশে পড়তেই
কান্নার শব্দ থেমে গেলো। তারপর
মেয়েটা আমার দিকে তাকাল। তার
চেহারাটা ঠিক বুঝে উঠার আগেই
সে রেললাইন থেকে হেঁটে পাশের
ঝোপের ভিতরে চলে গেলো।
আমি ঘড়ি দেখলাম ঠিক ৪টা বাজে।
বাসার
দিকে চলে যাবো ভেবে আমি উঠতে লাগলাম।
কিন্তু আমি উঠতে পারছিলাম না।
মারাত্মক ব্যাথা করছিল ঘাড়ে। অনেক
কষ্টে দাঁড়ালাম। কিন্তু শরীর
নাড়াতে পারছি না। খুব
বাজে একটা গন্ধ নাকে লাগছিল।
হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, কে যেন আমার
ঘাড়ে বসে আছে!!! তার দুই পা আমার
গলার দুই পাশ দিয়ে এসে ঝুলছে,
এবং দুই হাত দিয়ে সে আমার মাথার
চুল ধরে টানছে আর
মুখে খামচি দিচ্ছে। আমি চিৎকার
করতে থাকি আর হাত দিয়ে নিজের
মুখমণ্ডল বাঁচাতে প্রানপণ চেষ্টা করি।
এভাবে প্রায় কতক্ষন যায়। কখন বেহুঁশ
হয়ে গেছি বলতে পারবো না।
হুশ ফিরার পর নিজেকে বাসার
বিছানায় দেখলাম। পাশে আম্মু-আববু
বসে আছে। তারা আমাকে জিজ্ঞেস করল
“কিরে, কি হৈছিল? তোর মুখে কাটল
কিভাবে?”
আমি সব খুলে বললাম আর
জানতে চাইলাম
আমাকে এখানে কে নিয়ে আসছে।
তখন আববু বলল এলাকার কিছু আঙ্কেল
স্টেশনের পাশের মসজিদে নামাজ
পড়তে যান। তারা লাইন
ধরে হেঁটে আসছিলেন, হঠাৎ দূর
থেকে লাইন এর উপরে আমাকে দেখে,
তারা মনে করেছেন কোন লাশ!! হয়ত
ট্রেনে কাটা
পড়েছে। কিন্তু কাছে আসার পর
আমাকে জীবিত
পেয়ে তারা হাসপাতালে নিয়ে যান।
এর মাঝে আমাকে স্টেশন
গার্ড দেখে চিনতে পেরে আমার
বন্ধুকে ব্যাপারটা জানায়। তারপর
আমার ফ্রেন্ড আমার বাবাকে ইনফর্ম
করে। আববু গিয়ে আমাকে হাসপাতাল
থেকে নিয়ে আসেন। আববু এটা ও বলেন
যে আমাকে রেললাইন থেকে সময়
মতো না সরালে হয়তো আমি কাটা পড়তাম।
কারন ভোরের ট্রেনটা এর কিছুক্ষণ
পরেই আসে।
এরপর থেকে আমি মদ, গাঁজা, রাতের
আড্ডা একেবারেই ছেড়ে দেই।

No comments:

Post a Comment